দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বৈদিকযুগের ঋষিদের গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে অপপ্রচারের জবাব

অমৃতস্য পুত্রা
2
 

প্রশ্নঃ আপনার নিকট আমার একটি প্রশ্ন আছে। সম্প্রতি বোম্বাইস্থ ভারতীয় বিদ্যাভবন হতে প্রকাশিত History and culture of Indian People (Vol.1) নামক বইখানি দেখবার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, শ্রী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, এম.এ.ডি(প্যারিস) আরো প্রভৃতি দার্শনিক ও পণ্ডিতদের রচনার দ্বারা বই খানি সমৃদ্ধ। বইটির ‘The Vedic Age” নামক অধ্যায়ে বৈদিক যুগে বিবাহ ও স্ত্রীলোকের মর্যাদা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে শ্রীযুক্ত আপ্তে লিখেছেন- The guests are entertained with the flesh of cows, killed on the occasion (Rig.10.85.13) শুধু তাই নয়, The Vedic index (P-145) নামক পুস্তকেও দেখলাম Macdonel এবং Keith সাহেবও ঐ একই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বেশ জোরের সঙ্গেই লিখেছেন -The marriage ceremony was accompanied by the slaying of oxen, clearly for Food’ পড়ে মনটি বিষাদে ভরে গেল। শঙ্কা নিরসনের জন্য মূল ঋগ্বেদ (১০/৮৫/১৩) খুলে দেখলাম। তাতে আছে,
সূর্যায়া বহতুঃ প্রাগাৎ সবিতা যমবাসৃজৎ।
অঘাসু হন্যতে গাবো অর্জুন্যোঃ পর্য্যুহ্যতে।।
স্পষ্টতঃই লোখা আছে ‘হন্যতে গাবো’।
সত্যই কি বৈদিক যুগের ঋষিরা গোমাংস ভক্ষণ করতেন? এই জন্যই কি অতিথির প্রতিশব্দ ‘গোঘ্নঃ’? অশ্বমেধ, গোমেধ প্রভৃতি যজ্ঞে অশ্ব ও গরু বলি দেওয়া হত? সেকালে কি বিবাহবাসরে গোমাংসের সঙ্গে সোম পাক করে খাওয়ার বিধি প্রচলিত ছিল? প্রসিদ্ধ মহাত্মা তিব্বতী বাবা এবং অনেকে ঐ রকম মতের পরিপোষক ছিলেন। কিছুদিন আগে ইংরাজী সাহিত্যে কৃতবিদ্য আমার এক বন্ধু সোহং স্বামীর একখানা বই দেখিয়ে (অবশ্য মজা করবার জন্যই) বললেন যে, গোমাংস ভক্ষণ নাকি সম্পূর্ণ বেদসম্মত। যাহোক, আমাদের পূর্ব পুরুষরা গোখাদক ছিলেন, একথা মানতে প্রবৃত্তি হয় না। অনেক পণ্ডিত ‘গো’ শব্দের অর্থ ‘জিহ্বা’, ‘পৃথিবী’, প্রভৃতি করে একটা কষ্টকল্পিত অর্থ খাড়া করেন। কিন্তু ‘গোঘ্নঃ হন্যতে গাবো’ প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ এবং পুরাকালে অশ্বমেধ, গোমেধ প্রভৃতি যজ্ঞের কথা ভাবলে, রহস্যময় যৌগিক অর্থের দোহাই দিয়ে যুক্তিবাদী মন পরিতৃপ্ত হয় না। আপনি এ সম্বন্ধে যথোচিত আলোকপাত করলে বাধিত হব।

উত্তর দাতাঃ
শ্রদ্ধেয় মহাশয়,
আপনার সরল ও অকপট সত্য ভাষণের জন্য ধন্যবাদ। প্রথমেই আপনি একথা জেনে নিশ্চিন্ত হোন যে বৈদিক ঋষিরা গোখাদক ছিলেন না, বেদে অশ্ব বা গো হত্যার কথা কোথাও নাই। বেদ বুঝতে হলে যথোচিত তপস্যা, ব্রহ্মচর্য এবং স্বাধ্যায়ের প্রয়োজন হয়। তদভাবে মহর্ষি পাণিনির ব্যাকরণ, মহামুনি যাস্কাচার্য প্রণীত নিরুক্ত, শ্রী দুর্গাচার্য কৃত ভাষ্য, নিঘন্টু ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি আচার্যের কাছে পড়তে হয়। নতুবা বৈদিক শব্দের মর্ম বোঝা যাবে না।

যে সমস্ত পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিকে হেয় করার জন্য সর্বদা তৎপর; সায়ণ, মহীধর, উবট প্রভৃতি বিকৃত বেদব্যাখ্যাই যাদের একমাত্র সম্বল, তাঁদের বই পড়ে যারা বেদ বা বৈদিক সভ্যতা সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, তারা যত বড়ই পণ্ডিত ও দার্শনিক হিসাবে খ্যাতিমান হোন না কেন- তারা ভ্রান্ত, সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত।
 
ট্র্যাজেডি এই যে, যে দেশে গোমাতাকে ভগবতী জ্ঞানে পূজা করা হয়, কোন চর্ম নির্মিত বস্তু নিয়ে যে দেশে মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, গোহত্যাকারীদের যে দেশে ম্লেচ্ছ এবং যবন বলে নিন্দা করা হয়েছে সেই যুগ যুগ ধরে লালিত পবিত্র সংস্কারের বিরোধী গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণের কথা সে সব পণ্ডিতের উর্বর মস্তিষ্কে উদ্ভব হওয়াই যে সম্ভব! এ এক বিষম কলি কৌতুক! আমাদের দেশে একজন কোন বিষয়ে বড় হলেই তিনি মনে করেন যে তিনি সর্বজ্ঞ এবং পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার তাঁর জন্মে গেছে!

প্রাচীনকালে আমাদের দেশে অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞ করা হত। তাই কিছু কিছু পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোজী এদেশী পণ্ডিতরা মনে করেন যে, ঐ সব যজ্ঞকালে যথেচ্ছাভাবে অশ্বহত্যা ও গোহত্যা করা হত। তাদের ঐ ধৃষ্ট মন্তব্যের উত্তরে জিজ্ঞাসা করুন- আমাদের শাস্ত্রে তো পিতৃযজ্ঞের উল্লেখ আছে। তাহলে কি বুঝতে হবে ঐ সব যজ্ঞে মাতাপিতা এবং অতিথিবর্গকে হত্যা করা হত?
 
নিঘন্টুতে যজ্ঞের একটি প্রতিশব্দ হচ্ছে অধ্বর (৩/১৭) । “অধ্বর’ শব্দের নিরুক্তি করতে গিয়ে যাস্কাচার্য লিখেছেন- “অধ্বর ইতি যজ্ঞানাম্। ধ্বরতি হিংসাকর্মা, তৎপ্রতিষেধ, তৎপ্রতিষেঃ। (১/৮) ঐ মন্ত্রের ভাষ্য করতে গিয়ে 
 
শ্রীদেবরাজ যজ্বা লিখেছেন-
ধ্বরতের্বধ কর্মণঃ পুংসি সংজ্ঞায়াং ঘঃ (অষ্টাধ্যায়ী ৩/৪, ১১৮)
নঞ্পূর্ব। ধ্বরা হিংসা, তদভাবো যত। (নিঘন্টু ১/১৭)
এর অর্থ হল, অধ্বর শব্দটির দুটি ভাগ- অ+ধ্বর। ‘অ’ এর অর্থ নিষেধ, ‘ধ্বর’ এর অর্থ হিংসা করা। কাজেই অধ্বর শব্দের অর্থ হল হিংসা না করা। কাজেই যজ্ঞ শব্দের সার্থক প্রতিশব্দরূপে “অধ্বর” ব্যবহার করে যজ্ঞকালে প্রাণী হত্যা বা যে কোন রকমের হিংসা যে নিষিদ্ধ তা বৈদিক ঋষিরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এছাড়া যজুর্বেদের (১৩/১৪) নং মন্ত্রটি দেখুন; সেখানে ঋষির স্পষ্ট অনুশাসন ‘অশ্বং না হিংসীঃ। কাজেই অশ্বমেধ যজ্ঞ মানে যে অশ্ব বধ নয় তা প্রমাণিত হল।
এবারে ঋষিরা গরু খেতেন কিনা সে বিষয়ে একটু বিচার করা যাক।
 
 
বৈদিক শব্দকোষ নিঘন্টুতে ‘গো’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে পাই- অঘ্ন্যা, অদিতি, উস্রা, উস্রিয়া, অহী, মহী, জগতি ইত্যাদি- (২/১১)। নিঘন্টুর টীকাকার শ্রীদেবরাজ যজ্বা অদিতি শব্দের নির্বচন করেছেন- ‘নদ্যতি অখণ্ডনীয়া’ অথাৎ যার অঙ্গ ছেদন অনুচিত। অ+দিত অখণ্ডনীয়া। ‘গো’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে অদিতি শব্দের প্রয়োগ মনে রেখে এবার যজুর্বেদের দুটি স্পষ্ট ঘোষণা শুনুন-
 
গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্।।(১৩/৪৩)
গরু অদিতি- তা বধের অযোগ্যা, তাকে হিংসা কর না।
ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসীঃ পর মে ব্যোমন। ১৩/৪৬
 
শতপথ ব্রাহ্মণে ঐ মন্ত্রের ব্যাখ্যা পাই-
……..ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়েতি।….. এষু লোকেম্বনং মা হিংসীরীতি।।
 
অর্থাৎ মানুষকে যে ঘৃতদান করে তার নাম অদিতি, কাজেই তাকে হিংসা কোর না।
 
এইভাবে পরোক্ষ ব্যাখ্যা ছাড়াও যাস্কাচার্যের ব্যাখ্যাতে ‘গো’ শব্দের প্রত্যক্ষ অর্থও পাই।
 
তিনি লিখেছেন- “অথাপ্যস্যাং তাদ্ধিতেন তেন কস্নবন্নিসমা ভবন্তি। গোভিঃ শ্রীণীত। মৎসরামিতি পয়সা মৎসর সোমো, মন্ততেস্তৃপ্তি কর্মণঃ (নিরুক্ত ২/৫)
 
টীকাকার শ্রীদুর্গাচার্য এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “অথাপ্যস্যামেব পশুগবি, তাদ্বিতেন প্রয়োগেনাকৃৎস্নানায়াং সত্যাৎ কৃৎম্নবন্নিগমা ভবন্তি। তদযথাগোভিঃ শ্রীণীতমৎসরমিতি গোরেক দেশস্থ পয়সঃ কৃৎস্নবৎপ্রয়োগঃ। অর্থাৎ বেদে গো শব্দটি গরুর একদেশ অর্থাৎ দুধ সম্বন্ধেই প্রযুক্ত। এরই উদাহরণ দিতে গিয়ে যাস্ক, ‘গোভিঃ শ্রীণীতমৎসরম’ এই মন্ত্রভাগ উপস্থিত করেছেন। এর সরল অর্থ হল- গো অথার্ৎ দুধের সঙ্গে সোম পাক কর। কেউ কেউ ঐ কথা থেকে গোমাংসের সঙ্গে সোম প্রস্তুত কর, এই রকম অর্থ করেন। বৈদিক সাহিত্যে অনধিকারী নামকরা কোন কোন পণ্ডিত তাই স্পর্ধিত উক্তি করেছেন যে ঋষিরা গোমাংসের সঙ্গে সোম পাক করে খেতেন। তাঁর সোমেরও অর্থ বুঝেছেন মদ, তাই ঠিক এখন যেমন মাতালরা মদের সঙ্গে মাংস খায় তেমনি তাঁদের ধারণা হয়েছে, বৈদিক যুগে লোকে সোমের সঙ্গে গোমাংস খেতেন। এখন শুধু বিচার করে দেখুন সোম যদি মদ হয়, তাহলে মদকে কি কেউ পাক করে খায়?
 
অগ্নির তাপে মদের পরিণতি কি হবে তা কি ঐ কল্পনাবিহারী পণ্ডিতরা একবারও ভেবে দেখেছেন? কাজেই সোম মানে মদ নয়, তেমনি ‘গো’ শব্দের অর্থ গোমাংস নয়। গো বলতে বৈদিক দৃষ্টিতে দুধ বুঝাবে- এই রকম অর্থ যে করা হয়- সংস্কৃত এই নিয়ম ‘তাদ্ধিত’ নিয়ম নামে প্রসিদ্ধ। কাজেই বেদের যেখানে যেখানে যজ্ঞবাসরে গো শব্দটির প্রয়োগ দেখা যাবে, সেখানে সেখানে এই তাদ্ধিত নিয়মানুসারে দুধ অর্থই গ্রহণ করতে হবে।
 

এইবার আপনি যে বেদমন্ত্রটি উদ্ধৃত করেছেন (ঋগ্বেদ ১০/৮৫/১৩) এবং যেটির অর্থ নিয়ে Macdonel, Keith, Max Muller সাহেব থেকে আরম্ভ করে শ্রীযুক্ত বি,এল আপ্তে এবং শ্রীযুক্ত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত মহোদয় ব্যক্তিরা বিভ্রাট ঘটিয়েছেন, সেই মন্ত্রটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
 
ঐ মন্ত্রের দেবতা সূর্য। ঐ সম্পূর্ণ সূক্তটিতে সূর্য, পৃথিবী লোকের আকর্ষণ বিকর্ষণ প্রভৃতি নানা বৈজ্ঞানিক তথ্য ও দিব্যগুণের বর্ণনাই মুখ্য বিষয়। সেই সঙ্গে অলঙ্কার রূপে মানব সমাজের বিবাহাদি প্রথা সম্বন্ধেও অনেক শিক্ষণীয় উপদেশ আছে। ঐ মন্ত্রে হন্ ধাতু(হন্যতে) দেখেই বেদবিরোধীরা হত্যা অর্থ বুঝে বসে আছেন। কিন্তু বেদে ‘হন্’ ধাতুর অর্থ কেবল হিংসা বুঝায় না, হন্ ধাতুর অর্থ গতি (নিঘন্টু ২/১৪), জ্ঞান, গমন, চালনা করা, তাড়না করা, প্রেরণা দান প্রভৃতিও বুঝায়। ‘অঘাসু হন্যতে গাবঃ’ কথাটির লৌকিক সরল অর্থ হল, বৈদিক যুগে গরুই ছিল আর্যদের প্রধান সম্পদ, বিবাহাদিতে গরুই দান করা হত। মঘা নক্ষত্রে সূর্যের কিরণ মন্দীভূত হয়, কাজেই কন্যার পিতৃপ্রদত্ত গবাদি পশু ঐ সময়েই বরের গৃহে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত, আর “অর্জুন্যো পর্য্যুহ্যতে” অর্থাৎ ফাল্গুনী নক্ষত্রে কন্যা স্বামী গৃহে যাত্রা করতেন। প্রমাণ স্বরূপ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/১৩নং মন্ত্রটি দেখবেন, সেখানে ঠিক একই রকমের একটি মন্ত্র আছে। সেখানে কেবল “অঘাসু” স্থলে আছে “মঘাসু”। “অর্জুন্যো’ স্থলে আছে “ফাল্গুনীষু” আর “পর্য্যুহ্যতে” স্থলে আছে “ব্যুহ্যতে”।
প্রসিদ্ধ বৈদিক পণ্ডিত শ্রী ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদীজী ঐ মন্ত্রে ভাষ্য করেছেন-
 
(সূর্যায়াঃ) প্রেরিকায়া। সূর্যদীপ্তিবৎ তেজোবত্যঃ কন্যায়াঃ বহুতঃ এধি বহ্যশ্চতুঃ উ(১/৭৭) বহ প্রাপনো চতুঃ। বিবাহকালে কন্যায়ৈ দেয় পদার্থঃ বিবাহঃ। বহন কারণম্। (প্র আগাৎ) প্রকর্ষেণ গচ্ছতু (সবিতা) জনকঃ পিতা (যম্) পদার্থম্ (অবাসৃজৎ) দত্তবান্ (মঘাসু) মহ পূজায়ম অচ্ অর্শ আবচ। মঘ ধনানাম (নিঘন্টু ২/১০) সৎকারবতীষু ক্রিয়াসু ধনবতীষু (হন্যন্তে) গম্যন্তে। প্রাপ্যন্তে (গাবঃ) বাচঃ (ফাল্গুনীষু) ফলে গুর্ক্ চ উ(১/৫৬) ফল (নিষ্পতৌ) উণনা গুর্ক্ চ নীপ সফল ক্রিয়াসু (ব্যুহ্যতে) বিবিধনীয়তে।
 
 এর অত্যন্ত সরল ভাবার্থ হল- বিবাহকালে সুন্দরী কন্যাকে স্ত্রীধন হিসাবে নানা বস্ত্রালঙ্কার এবং গোধনাদি সম্পদ পিতা সাধ্যমত দান করবেন এবং আত্মীয়স্বজনাদি সমবেত সকলেই স্বস্তিবাচনের দ্বারা ঐ শুভকর্মকে সফল করে তুলবেন।

আশা করি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, ঐ মন্ত্রটিতে গোহত্যার কোন কথা নাই। ঠিক এমনইভাবে “গোঘ্নঃ’ শব্দটিতেও গোহত্যা কল্পনা করা য়ায় না। অঘ্ন শব্দের অর্থই ন হন্তব্যা- যা নিধনের যোগ্য নয়। গোমাতা অর্হনীয়া অথার্ৎ পূজার যোগ্য।
 
একথা সত্য বটে যে, ঋগ্বেদ(১০/৮৭/১৬০,) যজুর্বেদ (৮/৮৩) এবং অথর্ব্ববেদ (৯/৪/১৭) নানা মন্ত্রে গরুর নাম “অঘ্ন্য” বা “অঘ্ন্যা” বলা হয়েছে। কিন্তু ঐ “অঘ্ন্যা” শব্দের অর্থ কি?
 
মহর্ষি যাস্ক মুনি “অঘ্ন্যা” শব্দের অর্থ করেছেন- “অঘ্ন্যা অহন্তবা” (নিরুক্ত ১১/৪৪)। কাজেই গো শব্দটির সঙ্গে “অঘ্ন্য” যুক্ত আছে বলেই বরং গোহত্যার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করা উচিত নয়।
মহাভারতের শান্তিপর্বে স্বয়ং বেদব্যাস কেমন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন দেখুন- অঘ্ন্যা ইতি গবাং নাম ক এতান্ হন্তুমর্হতি?
 
আসল কথা হল- গোঘ্নোহতিথিঃ- এখানে ‘গোঘ্নঃ’ শব্দটি অতিথিপূজার অর্থবাদ মাত্র। অতিথির প্রতিশব্দ হিসাবে গোঘ্নঃ এই বিচিত্র শব্দটি প্রয়োগ করার মূলে বৈদিক ঋষির আশয় এই যে অতিথির জন্য গোধন হেন সম্পত্তিও ত্যাগ করা যায়, তাঁকে দান করা য়ায়। কারণ এই যে অতিথি নারায়ণ, তাঁর পরিচর্যার জন্য যদি গোমাতাকে ত্যাগ ও তাড়না করতে হয় তাও করা উচিত। মহর্ষি পাণিনির, দাশ গোঘনৌ সম্প্রদানে ৩/৪/৭৩ এই মন্ত্রটি মনন করলে আমার ব্যাখ্যা যে সত্য তা প্রমাণিত হবে। পাণিনির ঐ সূত্রের কাশিকা ও ন্যাস টীকায় বলা হয়েছে যে, অতিথির চেয়ে গরুকে এইভাবে হেয়ত্ব গরুর অপমান। অপমান মৃত্যুতুল। কাজেই অতিথি গোঘ্নঃ সত্য সত্য অতিথির জন্য গৃহস্থ গোহত্যার মত মহাপাপে লিপ্ত হবেন না। তা যদি হতেন, তাহলে নিমিত্ত কারণ হিসাবে অতিথিকে চণ্ডাল বলা হত- “নিপাতন সামর্থ্যাদেব ঘোঘ্ন ঋত্বিগাদিরুচ্যতে, ন তু চণ্ডালাদিঃ। অসত্যপি গোহননে তস্য যোগ্যতয়া গোঘ্ন ইত্যভিধীয়তে
 
পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের শ্রম, অধ্যবসায় এবং জ্ঞানপিপাসা প্রশংসনীয় হলেও, ভারতীয় মানসিকতা তাঁরা পাবেন কি করে? কাজেই তাদের বৈদিক শব্দের অর্থবোধ যথাযথ না হওয়াই অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কিন্তু আমার বড় দুঃখ হয়ে যে, নিজেদের পিতৃপুরূষেদের আচরিত ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে অবলীলাক্রমে কিছু লিখতে কিংবা বলতে গিয়ে ভারতীয় পণ্ডিতদের একবারও বুক কাঁপলো না। তারা যে কিভাবে গোঘ্নঃ শব্দ হতে বৈদিক যুগে গোমাংস ভক্ষণের সিদ্ধান্তে আসেন তা আমার বুদ্ধির অগম্য। অত কথা কি, তারা যদি বৈদিক শব্দকোষ মূল নিঘন্টুটাই একটু ভাল করে পর্যালোচনা করেন, তাহলেই তাদের এ বিষয়ে ভ্রম হতে পারে না। নিঘন্টুতে(২/১৪) গত্যর্থক ধাতুমালাতে হন্ ধাতুর উল্লেখ আছে- হনতি, হন্তি, হন্তাৎ।
 
কিন্তু ঐ নিঘন্টুর(২/১৯) বধার্থক ধাতুমালাতে ‘হন’ ধাতুর প্রয়োগ সর্বথা নাই। সুতরাং বেদে গোঘ্ন শব্দের অর্থ বধ অর্থে গ্রহণ করা যায় না। কাজেই পূর্বাপর সংগতি বজায় রেখে বুঝতে চাইলে বলতে হয়- গোঘ্ন শব্দের অর্থ, গাং হন্তি- গচ্ছতি অস্মৈ ইতি- গোঘ্নোহতিথিঃ। অস্মৈ অতিথ্যর্থে দুগ্ধাদি প্রাপণার্থং গোপার্ম্বং গচ্ছতি। এইভাবে এই অর্থে অতিথিকে গোঘ্ন আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
 
আর একটি কথাও প্রণিধান যোগ্য। হিংসা শব্দের অর্থ তাড়না করাও বুঝায় তা আমি পূর্বে দেখিয়েছি। শ্রী দুর্গাচার্য লিখেছেন- নিহন্তি অভিগচ্ছন্তি প্রাপ্নোতি ইত্যর্থঃ।

যে সব ভারতীয় পণ্ডিতদের লেখা পড়ে আপনার নৈষ্ঠিক মন বিষাদে ভরে গেছে সেই সব পণ্ডিতদের গুরুঠাকুর হলেন Macdonel, Max Muller প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত। আবার এই সব পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের মাথার মণি হলেন সায়ণাচার্য। এখন এই সায়ণাচার্যই “মঘাসু হন্যতে গাবঃ অর্জুন্যো পর্য্যুহ্যতে’- এই মন্ত্রটির কি অর্থ করেছেন দেখুন তিনি লিখেছেন- ‘মঘাসু গাবঃ সবিত্রা দত্তাঃ সোমগৃহং প্রতি হন্যন্তে দণ্ডৈস্তাড্যন্তে প্রেরণার্থম্ ইতি- অর্থাৎ বিবাহের দিন কন্যার পিতা বরকে যে গরুবাছুর দান করেন, সেগুলি বরের বাড়ী তাড়না করেই নিয়ে যেতে হত। অনেকসময় স্বধর্মনিষ্ঠ গৃহস্থ দক্ষিণা হিসাবে অতিথিকে গরু দান করতেন। কাজেই- গাং হন্তি তাড়য়তি অস্মৈ প্রদানাদ্যর্থম- এই অর্থে এবং “দাশ গোঘনৌ সম্প্রদানে’ পাণিনির এই সূত্রানুসারে- সম্প্রদান অর্থে ‘গোঘ্ন’ শব্দ সিদ্ধ হয়।
 
এখন আপনারাই বিচার করে বলুন, আপনারা কার কথা মানবেন? কেমব্রিজের ডক্টরেট ডিগ্রীধারীর কথা, না- মহর্ষি পাণিনি ও যাস্কাচার্যের কথা? বেদের অর্থ যথাযথভাবে কে বেশী বুঝবেন বলে মনে হয়? ঋষি দেবরাজ যজ্বা ও শ্রীদুর্গাচার্যের মত বেদজ্ঞ প্রজ্ঞাবান পণ্ডিত, না – প্যারিস বা মরিসের ডক্টরেট উপাধিধারী?

ইংরাজীর মাধ্যমে বেদজ্ঞান আহরণ না করে কেউ যদি মূল বেদ পড়েন, তাহলে নিন্ম লিখিত মন্ত্রটি তার চোখে না পড়ার কথা নয়। এখানে গরুকে গোমাতা বলে স্তুতি করা হয়েছে।
 
গরু হল বসু, রুদ্র আদিত্যদের কন্যা, মা ও ভগিনীর সমান। গরু দুধ রূপ অমৃত দান করে। সকলে জেনে রাখ, গরু- যার অদিতি, তাকে বধ করো না। মা বধিষ্ট। (ঋগ্বেদ ৮/১০১/১৫)
 
ঋগ্বেদের ঐ মন্ত্রটি ছাড়াও যজুর্বেদের মন্ত্রে গরুর প্রতিশব্দগুলির অর্থ গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন।
সেখানে ঋষি গরুকে কি বলে সম্বোধন করেছেন দেখুন-
ইড়ে রন্তে হব্যে কাম্যে চণ্ডে জ্যেতিঅদিতে সরস্বতি মনি বিশ্রুতি।
এতা তে অঘ্ন্যে নামানি দেবেভ্যো মা সুকৃতং ব্রুতাৎ।।
ইড়া- অন্নদাত্রী, উৎসাহদাত্রী; রন্তা- আনন্দদায়িনী; হব্যা- আদরণীয়া, পূজানীয়া; কাম্যা- রমণীয়া; চন্দ্রা- সুদর্শনা; জ্যোতি- দীপ্তিময়ী পুষ্টিদায়িনী; অদিতি- অখণ্ডনীয়া, সরস্বতী- সুরসদায়িনী; অঘ্ন্যা- অবধ্যা ইত্যাদি।
উপরোক্ত প্রত্যেকটি শব্দের গভীর অর্থ আছে। তা বাদ দিলেও ঋষিরা যেভাবে এক একটি সুনির্বাচিত শব্দে গরুর মহিমা কীর্ত্তন করেছেন, তাতে একমাত্র অভিসন্ধিপরায়ণ নিন্দুক ছাড়া ঋষিরা গোখাদক ছিলেন একথা বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

এরই পাশাপাশি, গরুকে যারা হিংসা করবে তাদের প্রতি বেদের শাসনবাক্য শুনুন-
আরে তে গোদনমুত পুরষঘ্নম্।।(ঋগ্বেদঃ ১/১১৪/১০)- ‘গোহত্যাকারী ও নরহত্যাকারী দূর হও।’
 
আশাকরি আপনি এতক্ষণে স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে, গোমাংস ভক্ষণের রীতি কখনই হিন্দু সমাজে ছিল না।
যারা সংস্কৃতে অনভিজ্ঞ তারা ভারতবিশ্রুত পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক ডঃ শ্রীরাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের Hindu Civilisation নামক গ্রন্থটি পড়লে দেখবেন সেখানে তিনি বৈদিক অর্থ যথাযথভাবে বুঝে লিখেছেন- The cow was already deemed aghnya- not to be killed.
 
এতসব স্পষ্ট প্রমাণ সত্ত্বেও যদি কোন ভারতীয় পণ্ডিত বলেন যে, পূর্বকালে ঋষিরা গোমাংস খেতেন তাহলে রূঢ় শোনালেও বাধ্য হয়েই বলতে হয় যে, ‘পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের উচ্ছিষ্ট ভোজী’ ঐ সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথা অবজ্ঞা করাই উচিত। আমাদের পুণ্যশ্লোক পিতৃপুরুষগণ অর্থাৎ পবিত্রাত্মা ঋষিগণ কখনই ঐরকম অভক্ষ্য ভক্ষণ করতেন না। এইটাই প্রকৃত বৈদিক সিদ্ধান্ত।

Post a Comment

2Comments
  1. সবই বুঝলাম , কিন্তু হিন্দুরা (সনাতনীরা) আমি নিজেও সনাতনী তবে আমরা প্রায়শই শুনে থাক যে,হিন্দুরা সাধারণত শূকর খায় ।এই ব্যাপারটির সত্যতা কি? আদৌ কি এইটা আমাদের পূর্বপুরুষরা এইটা সত্যিই করত। বিষয়টি একটু জানার অভিপ্রায় প্রকাশ করছি ।

    ReplyDelete
  2. মাংস ভক্ষণের কোনো বিধান সনাতন শাস্ত্রে নেই।

    ReplyDelete
Post a Comment